Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

রাজধানী আক্রা নগরী থেকে বেশ খানিকটা দূরে, সমুদ্র-উপকূলবর্তী



ঘানার রাজধানী আক্রা নগরী থেকে বেশ খানিকটা দূরে, সমুদ্র-উপকূলবর্তী একটি জনপদে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে আসি কামরা থেকে। গেস্টহাউসের ওপরতলার ওপেন সিটিং এরিয়ায় মানিপ্লান্টের লতানো কুঞ্জের কাছে চুপচাপ বসে আছে ব্রিয়ানা। সে ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরার স্ক্রিনে কিছু একটা খুঁটিয়ে দেখছে। আজ ব্লু-জিন্সের সঙ্গে কেনতে-ক্লথের সিøভলেস টপ পরেছে, মাথায়ও ব্রেইড করা উইগ, এতে এ আফ্রো-আমেরিকান নারীটিকে দেখাচ্ছে ঘানায় জন্ম নেওয়া তরুণীদের মতো। আজ আমরা একত্রে আক্রা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে কেইপ কোস্ট নামে একটি শহরে যাচ্ছি। এ-যাত্রার আয়োজন করেছে ব্রিয়ানা, মিনিট দশেকের মধ্যে ট্যুর কোম্পানির এয়ারকন মাইক্রোবাস আমাদের তুলে নেবে। বাসভাড়া থেকে যাত্রার খরচাদি পুরোটাই বহন করছে সে।
আমি ও ব্রিয়ানা সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউন থেকে দিনচারেক আগে আক্রা নগরীতে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে এ-যাত্রাবিরতিতে আমি ঘানায় খানিক পর্যটন করছি। ফ্রিটাউনে ব্রিয়ানার বসবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সে এখনই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে চাচ্ছে না। ব্রিয়ানা চেষ্টা করছে ঘানায় দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পাওয়ার, যা তাকে অত্র এলাকা বিশদভাবে পর্যটন করতে সহায়তা দেবে। ইবোলার দুর্বিপাকের সময় আমরা দুজনে ফ্রিটাউনে কাজ করেছি। ওখানে রোগ সংক্রমণের আতঙ্কে হোটেলাদি বন্ধ হয়ে গেলে কিছুদিন ব্রিয়ানা আমার কটেজে বাস করেছিল। তাই আজ আমাকে সে অ্যা থ্যাংক য়্যু ট্রিপটি উপহার দিতে যাচ্ছে।
আজ আমাদের গন্তব্য আক্রা থেকে আড়াই ঘণ্টার ড্রাইভিং দূরত্বে অবস্থিত জনপদ কেইপ কোস্ট। সেখানকার ঔপনিবেশিক আমলের দুর্গটিও কেইপ কোস্ট ক্যাসল নামে পরিচিত। এ-কেল্লা এক জমানায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে কিডন্যাপ করে অন্তরীণ করে রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো। অত্যাচার ও অনাহারে তারা শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে নিলে, শিকল প্যাঁচানো শরীরে ব্র্যান্ডিংয়ের দাগ বা তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে সেøভ ট্রেডিং কোম্পানির লোগো উল্কি করে, জাহাজের খোলে পুরে তাদের চালান দেওয়া হতো আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। ক্রীতদাস ব্যবসাসংক্রান্ত বইপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ঔপনিবেশিক শাসনের চারশো বছরে আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ক্রীতদাস হিসেবে চালান দেওয়া হয়েছিল কমবেশি এক কোটি বিশ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে। এ-সংখ্যার এক ব্যাপক অংশ ছিল তৎকালীন ঘানার মানুষজন। তাদের অত্যন্ত হিংস্রভাবে কিডন্যাপ করে, শিকল পরিয়ে, অন্তরীণ করে রাখা হতো উপকূলের চল্লিশটি ভিন্ন ভিন্ন কেল্লায়। এ-কেল্লাগুলোর একটি বা দুটি দেখার আমার আগ্রহ ছিল, কিন্তু আক্রায় জানাশোনা সুহৃদদের সঙ্গে সহবতে এ-কদিন ভারি ব্যস্ত ছিলাম, তাই উদ্যোগ নিতে পারিনি। ব্রিয়ানা এ-আয়োজনটি করে দিয়ে ফের আমার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে।
আমি তার কাছে গিয়ে উলটোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলি, ‘হাই, হাউ আর ইউ ডুয়িং টুডে, ব্রিয়ানা?’ সে ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে হাসে, তাকে কেমন যেন সেন্টিমেন্টাল দেখায়। হাত তুলে কপালে এসে পড়া চুলের সর্পিল ব্রেইড সরিয়ে সে বলে, ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু দিস ট্রিপ।’ তখন খেয়াল করি, তার নিরাভরণ বাহুতে শিকড়-বাকড় ও লতার কষ দিয়ে আঁকা উল্কি। এ-ধরনের জ্যামিতিক প্যাটার্ন ঘানার গ্রামাঞ্চলে কাদা-মাটি-ছনের কুঁড়েঘরে দেখা যায় বিস্তর। আমি নকশাটির তারিফ করে বলি, ‘দ্য জিওম্যাট্রিক ডিজাইন অব ইয়োর ট্যাটু লুকস ফেবুলাস।’ সে লাজুকভাবে হেসে জবাব দেয়, ‘দিস ইজ নট ট্যাটু, বাট অ্যা কাইন্ড অব বডি পেইন্ট, তিন-চারদিন থাকবে, তারপর গোসলে ধুয়েমুছে যাবে।’ নিচ থেকে ওয়েটার এসে জানায়, ট্যুর কোম্পানি ফোন করেছে, তাদের মাইক্রোবাস হোটেলে পৌঁছতে মিনিট পনেরো দেরি হবে। ব্রিয়ানার কপাল কুঁচকে ওঠে। যাত্রার শুরুতে দেরির সম্ভাবনা আমাকে উদ্বিগ্ন করে না, ট্যুর কোম্পানির মাইক্রোবাস আমাদের পিক করতে সময়মতো এসে পৌঁছলে আমি বরং ‘আচরণটিকে’ অ্যাবনরমাল বিবেচনা করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম। ওয়েটারকে আমি হরলিক্স সার্ভ করার অনুরোধ করি। ব্রিয়ানা আদুরে ভঙ্গিতে গ্রীবা হেলিয়ে বলে, ‘ইয়েসটারডে – সামথিং ওয়ান্ডারফুল হ্যাপেনড টু মি, মিনিস্ট্রিতে ধরনা দিয়ে ভিসা এক্সটেন্ড করিয়েছি। নব্বই দিনের সিল মেরে দিয়েছে। তো আমি আপাতত আর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাচ্ছি না, সেøভ ক্যাসলগুলো আমার দেখা চাই। হাতে সময় যখন পাওয়া গেছে, আস্তে-ধীরে উপকূলের চল্লিশটি কেল্লা ঘুরেফিরে দেখে তারপর কোথায় যাওয়া যায় – তা ডিসাইড করব।’ আক্রা এয়ারপোর্টে তাকে মাত্র সাতদিনের ভিসা দিয়েছিল, তার ভিসা এক্সটেন্ড হওয়ায় আমি খুশি হই, বলি, ‘কংগ্র্যাচুলেশনস, ব্রিয়ানা’, সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ‘আই ফেল্ট সো হ্যাপি ইয়েসটারডে … তো মিনিস্ট্রি থেকে বেরিয়ে মার্কেটে গিয়ে বডি পেইন্ট দিয়ে বাহুতে নকশা আঁকিয়ে নিলাম।’
করিডোর ধরে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে অত্যন্ত কায়ক্লেশে এদিকে আসছেন প্রৌঢ় একজন আফ্রো-আমেরিকান মানুষ। গালফ যুদ্ধে অংশ নেওয়া এ অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের নাম সার্জেন্ট সুগাররে বার্চউড। তিনদিন আগে তিনি এসে উঠেছেন এই গেস্টহাউসে। আমার সঙ্গে তাঁর বাতচিত হয় ব্রেকফাস্ট লবিতে। যুদ্ধে আহত হওয়া মানুষটি তার জ্যাকেটের ল্যাপেলে সামরিক অর্জনের নিশানাস্বরূপ একটি মেডেল ঝুলিয়ে একা বসেছিলেন। আমি তাঁকে হ্যালো বলে তাঁর টেবিলে বসলে তিনি খুশি হয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল ইমোশনালি ক্ষতবিক্ষত হওয়া অভিব্যক্তি। নাশতা খেতে খেতে টুকটাক কথাবার্তায় আমি তাঁর ফ্র্যাংকনেস অনুভব করতে পেরে ভারি অবাক হয়েছিলাম! ব্রেকফাস্ট ব্যুফেতে দীর্ঘ কাউন্টারে সাজিয়ে রাখা ছিল বিবিধ রকমের খাবার। ফলফলাদি থেকে চিজ, ইয়োগার্ট, বেকন, সসেজ কিংবা অমলেট কোনো কিছুর অভাব ছিল না। সার্জেন্ট সুগাররে ওটমিলের পরিজ খেতে খেতে বারবার আফসোস করছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি নাকি কখনো ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সুযোগ পাননি। শিশুবয়সে পিতা তাঁর মাকে খুন করার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাগারে কাটান। তিনি বেড়ে ওঠেন আলাবামা অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর টাসকুমবিয়ায় তাঁর দিনদরিদ্র চাচির বাড়িতে। গির্জার ধর্মযাজকরা বাইবেল স্কুলে তাঁকে লেখাপড়া শেখান, সেখানে ফ্রি লাঞ্চ খেয়ে দিনযাপন করতেন। যুবক বয়সে তিনি বিত্তবানদের ম্যানসনগুলোর বাগানে ঘাস কাটা ইত্যাদি কাজ করে সামান্য আয়-উপার্জন করতেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের বছর দুয়েক আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধে একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে সম্মানজনকভাবে ডিসচার্জ দেওয়া হয়। অবসর পেয়ে আহত শরীর নিয়ে ভারি সংকটে পড়েছিলেন সার্জেন্ট সুগাররে। সামান্য যে-পয়সা পেনশন পেতেন তা দিয়ে ঘর ভাড়া করার কোনো উপায় ছিল না, ততদিনে তাঁর চাচিও প্রয়াত হয়েছেন। উপরন্তু দু-পায়ে একাধিকবার অপারেশনের ফলে সাফার করছিলেন ক্রনিক পেইনে। পেনশনের সিংহভাগ চলে যেত পেইনকিলার কিনতে। আলাবামার একটি হোমলেস শেল্টারে সার্জেন্ট তাঁবুতে বাস করছিলেন, হঠাৎ করে আক্রান্ত হন স্ট্রোকে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গির্জার এক সহানুভূতিসম্পন্ন উকিলের সহায়তায় সেনাবাহিনীকে মামলার নোটিশ দেন। এ প্রক্রিয়ার ফলে তাঁর হাতে এসে যায় কমপেনসেশন হিসেবে বেশকিছু টাকা। সার্জেন্ট সুগাররে এ-পয়সাটি ব্যয় করছেন তাঁর পূর্বপুরুষ ক্রীতদাস মিস্টার বার্চউডের দেশ ঘানায় ভ্রমণ করে।
অনেক সময় নিয়ে করিডোর অতিক্রম করে ওপেন সিটিং এরিয়ায় এসে সার্জেন্ট সুগাররে আমাদের কাছে একটি সোফায় বসেন। আজ তিনিও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন কেইপ কোস্ট ক্যাসলটি দেখতে। বসেই তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, ঘানার রাজপথে গাড়িঘোড়ার চলাচলে অ্যাক্সিডেন্ট হয় হামেশা। জীবনে একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, পূর্বপুরুষ মিস্টার বার্চউডের দেশে এসে তিনি কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে চান না। কথা বলতে বলতে তাঁর মুখের দু-কোণ বেয়ে লালা গড়ায়। এ-সমস্যাটা আমি তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আগেও খেয়াল করেছি। ওটমিলের পরিজ গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর জ্যাকেটে। স্ট্রোকে সম্ভবত তাঁর মুখের মাসলগুলো শিথিল হয়ে গেছে। ব্রিয়ানা উঠে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে তাঁর মুখ মুছিয়ে দেয়। সার্জেন্ট সুগাররে খুশি হয়ে ব্যাকপ্যাক থেকে ছোট্ট একটি বাইবেল বের করে বলেন, ‘গাইজ, লুক, হোয়েনএভার ইউ আর অন দ্য রোড, দেয়ার আর অলওয়েজ পসিবিলিটিজ অব অ্যাক্সিডেন্টস, চলার পথে আমাদের মাথার ওপর সবসময় ঝুলছে দুর্ঘটনার খাঁড়া। খুব বেশি এংজাইটি হলে আমি বাইবেলে সমাধান খুঁজি। লর্ড জিসাস ক্রাইস্ট অলঅয়েজ হেল্পস মি।’ তিনি একটু ইতিউতি করেন, অতঃপর জানতে চান, ‘আমি বাইবেল থেকে একটু পড়লে তোমরা মাইন্ড করবে কি?’ ব্রিয়ানা তাঁকে বাইবেল তর্পণ করতে উৎসাহিত করে। সার্জেন্ট সুগাররে একটি পৃষ্ঠা থেকে মৃদু স্বরে পড়ে যান, ‘হি উইল কমান্ড হিজ অ্যাঞ্জেলস কনসারনিং ইউ টু গার্ড ইউ ইন অল ইয়োর ওয়েস।’ পড়তে পড়তে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে অসহায় হাসি। বাইবেলের পবিত্র বচনটির সরল ভাবানুবাদ হতে পারে, ‘ঈশ্বর তোমার তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত দেবদূতদের নির্দেশ দেবেন তোমার সকল চলার পথে নিরাপত্তা বিধান করতে।’ তো আজকের ট্রিপে ঐশী সূত্র থেকে আশীর্বাদ পাওয়া গেলে তো মঙ্গল, আখেরে উপকৃত হবো আমরা সকলে; কিন্তু সার্জেন্ট সুগাররেকে ফের উদ্বিগ্ন হতে দেখি। তিনি আসমানি কিতাবটি ব্যাকপ্যাকে রেখে অস্থিরতা ছড়িয়ে যা বলেন তার সারসক্ষেপ হচ্ছে – যাত্রাপথে সর্বত্র তিনি ওয়াকার ব্যবহার করতে পারবেন না। একটি রেঞ্চজাতীয় শলাকা দিয়ে ওয়াকারটি ভেঙে দু-

Post a Comment

0 Comments